কলাম

দুটি বিষয়: একটি প্রশ্ন


এক.
একসময় সমাজে লেখক ছিলেন হাতেগোনা। লেখালেখি করতেন হয়তো দশজন, পড়তেন কয়েক হাজার পাঠক। আজ সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন লেখালেখি করেন কয়েক হাজার লেখক (ফেসবুক-অনলাইনে)। আর পাঠক এখন হাতেগোনা। সেকালের লেখক-সংখ্যার স্থান দখল করেছেন একালে পাঠক, আর পাঠকসংখ্যায় যেতে বাধ্য হয়েছেন লেখকেরা।

দুই.
একসময় কেবল বই (কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ) প্রকাশিত হতো সাহিত্যিকদের। আর কিছু ছিল সাংসারিক-ধর্মীয়-ব্যবহারিক-পাঠ্যবই। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন প্রকাশিত বইয়ের (কবিতা-গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ) ৯০ শতাংশই হলো অসাহিত্যিকদের। যেমন, কেউ হয়তো দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে আছেন। তিনি ভাবলেন, এতদিন সাহিত্যবিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দিলেন, এখন নিজেরও লেখার সময় হয়েছে। তাই তিনিও লেখক বনে গেলেন। তার বই বিক্রিও হয় যথেষ্ট পরিমাণে (কারণ, তাই বই আর কেউ না কিনলেও ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র সহকর্মীরা তো কেনেন)। প্রকাশকরাও খুশি।

তিন.
কেউ হয়তো দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন কিংবা সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেছেন। অনেককে চাকরি দিয়েছেন। সমাজসেবা করেছেন। এখনও করছেন। যাচ্ছেন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি হয়ে। এসব সভা-সেমিনারে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তাদের কথা বলতে হয়। বলেনও। তাদের এসব বক্তব্য-মন্তব্য শুনে কোনো তোষামোদকারীও সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে। নিজের কোনো বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ওই রাজনীতিবিদকে প্ররোচিত করেন কলম ধরতে। ব্যস, আর যায় কোথায়? শুরু হয় লেখালেখি।

চার.
ছাপানোর জায়গা? অভাব নেই। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক-চাকরিজীবনের সুবাদে বহু দৈনিকের সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। একটি মাত্র ফোনকলই যথেষ্ট। তাদের লেখা সাহিত্যপাতার প্রথম পৃষ্ঠায় দৃষ্টিনন্দন অলঙ্করণসহ কিংবা অনলাইনে গুরুত্বসহ প্রকাশিত হয়। বছর শেষে ওই লেখাগুলো দিয়েই প্রকাশিত হয় ঢাউস বই।

পাঁচ.
কেবল বই প্রকাশিতই হয় না। ওই সব বই বিভিন্ন করপোরেট পুরস্কারও বাগিয়ে নেয়। পাঠক না পড়লেও তাদের বই নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে, বিভিন্ন ক্লাবে তরল পানীয়ের সঙ্গে।

ছয়.
আর একটি কথা। আমলা লেখক হলে তো আর কথাই নেই। তার বই প্রকাশের আগেই বিক্রি হয়ে যায় হাজার কপি। কারণ দেশব্যাপী তার অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তারা বসকে খুশি করার জন্য হলেও বই কিনে নেন এবং বইকেনার ছবি তুলে বসকে পাঠান। ফলে আমলা লেখকদের বই করে প্রকাশকরাও লাভবান হন। (এটি অনুমান ভিত্তিক, এই বিষয়ে প্রকাশকরা আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে, আমিও দীর্ঘদিন যাবত প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় কিছু কিছু তথ্য জানি)।

সাত.
এখন প্রকৃত সাহিত্যচর্চার সময় নয়। সেই রুচিও নেই এই সমাজের। এখন ফেসবুক স্ট্যাটাসই প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। বরং সুবিধাবাদীরা এখন প্রশ্ন তুলতে পারেন, ‘কে আর এমন বেকুব আছে, নগদ ছেড়ে বাকির লোভে সাহিত্যচর্চা করবে? আপনি কী আর এমন করছেন? বসে বসে বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চার কথা ভাবছেন? রুচির কথা ভাবছেন? রুচি ধুয়ে পানি খাবেন?’

মন্তব্য