কলাম

খাদ্য নিরাপত্তায় প্রয়োজন সরকারের নিয়ন্ত্রণ


বাংলাদেশে খাদ্য সংকট এক সময় অনেক বড় সমস্যা ছিল। বর্তমানে সে সমস্যা নেই। তবে খাদ্য সংকট না থাকলেও দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার সংকট আছে। এ কথা সত্য, দেশে খাদ্য উৎপাদন যথেষ্ট হচ্ছে। সরকার খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগুচ্ছে ক্রমশ। আগের মতো অতিমাত্রায় আমদানি খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল নই আমরা। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে—করোনো ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে চলছে লকডাইন। ঘরবন্দি মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। দেশের বেসরকারি সেক্টরের প্রচুর মানুষ চাকরি হারানোর আশঙ্কায়। ব্যবসা-বাণিজ্যেও চলছে মন্দাভাব। এ পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানের ওপর যদি বড় একটি আঘাত আসে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অচিরেই ক্রয়ক্ষমতা হারাবে। অন্যদিকে ক্রয় ক্ষমতার অভাবে খাদ্য নিরাপত্তার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেও।

এরই মধ্যে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ হতে পারে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারেন। কৃষি উৎপাদন হ্রাস ও অনেক দেশ খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে এমন আশঙ্কাকে দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। যদিও দুর্ভিক্ষের শীর্ষ ঝুঁকির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। তবু আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। এক্ষেত্রে কৃষি খাতে সরকারের বেশ কিছু আগাম প্রস্তুতি বেশ প্রশংসার দাবিদার। চলমান ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীদের জন্যও ব্যাপকভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে সরকার, যেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল থাকে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না কমে।

যদিও দুর্ভিক্ষের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতির বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীতে খাদ্য সংকট হলে অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে এই বিবেচনায় সরকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থাৎ আট লাখ টন খাদ্য লটারির মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে সরবরাহ করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া ১০ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল, দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল ও ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম কেনা হবে। তবে, এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতি থাকলেও সম্ভাব্য সংকটের কথা বিবেচনা করে খাদ্য মজুত, বাজারজাত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি আরও জোরালো করা দরকার। কারণ খুচরা বাজারে খাদ্য পণ্যের দামের ওঠা-নামার চিত্র আমাদের অজানা নয়। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই চালের বাজার চড়া হতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। সুযোগ পেলেই অসাধু সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা করে থাকে। সংকটের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে জনমনে তার মারাত্মক খারাপ প্রভাব পড়বে। এজন্য খাদ্য সরবরাহ, বাজার ব্যবস্থাপনা ও দাম নিয়ন্ত্রণে পাইকারি ও খুচরা মার্কেটে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। অবশ্য বাজারের অবস্থা খুবই নাজুক দেখা দিলে সরকারকে মাঝে-মাঝে সাময়িক কিছু উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সাময়িক নয়, স্থায়ী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।

এ প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্য থাকাটাই খাদ্য সরবরাহের একমাত্র পূর্বশর্ত নয়, এক্ষেত্রে বহুবিধ মধ্যবর্তী শক্তির প্রভাব নির্দিষ্ট পরিবারবর্গের ক্রয়ক্ষমতাকে বিপন্ন করে। অর্থাৎ বহুবিধ মধ্যস্বত্বভোগী যারা রয়েছেন তারা বাড়তি মুনাফার লোভে খাদ্য মজুত করতে শুরু করে দিলেই খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। এতে খাদ্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ, মহামারিতে এবং বিনা চিকিৎসায় একের পর এক মানুষ মারা যেতে থাকে।’

নিত্যনতুন প্রযুক্তি, আধুনিক বীজ, রাসায়নিক, কৃষকবান্ধব সরকারি প্রণোদনা আর কৃষিখাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাবও অনেকটা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

এ অবস্থায় খাদ্যপণ্যের দাম ও মজুত নিয়ে কারসাজি, কৃত্রিম সংকট কিংবা সিন্ডিকেটের বাজার নিয়ন্ত্রণের পুরো ব্যবস্থাটা ভেঙে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি। কেননা দেশে পেঁয়াজের সংকট কাজে লাগিয়ে মজুতদারদের বাজার নিয়ন্ত্রণের টাটকা উদারহণ দেশবাসী ভোলেনি।

ডব্লিউএফপির দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মাথায় সেই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা তখন কেমন ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। ২৫ বছর শোষণের শিকার প্রিয় মাতৃভূমি গড়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে অনাবৃষ্টি আর ১৯৭৪ সালে বন্যায় আউশ ও আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তীব্র খাবারের অভাব দেখা দেয় দেশে। একই সময় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেলসংকট দেখা দেওয়ায় দেশে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। হু হু করে বাড়তে থাকে জিনিসপত্রের দাম, দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি, আর্থিক মন্দা। বৈশ্বিক এ সংকট আঘাত করে বাংলাদেশে অর্থনেীতিতেও। এ অবস্থায় নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা দেয় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি।

সেই সময় প্রায় প্রতিটি জিনিস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো বাংলাদেশকে। ওই পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু সরকার প্রচুর খাদ্যশস্য আমদানি করে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেছিল। ৫ হাজার ৭০০ লঙ্গরখানা খুলেছিল সরকার। হেলিকপ্টারে করে খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল দুর্গত এলাকায়। তবে কষ্টদায়ক ব্যাপার হলো, সে সময়ও রিলিফ বণ্টনে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছিল একটি অসাধু চক্র। একইভাবে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদাররা মুনাফার লোভে দেশকে খাদ্য সংকটের মুখে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করে। ওই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও যথাসময়ে সাহায্য পাঠায়নি। অন্য দিকে কিউবায় চটের ব্যাগ বিক্রির অজুহাতে বাংলাদেশে সাহায্য বাতিল করেছিল আমেরিকা। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন গরিব একটি দেশকে এভাবে এক সঙ্গে এতগুলো কঠিন সংকট সেই সময় মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

ওই সময় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আজ তিনটি মহাবিপদ তথা তিন শত্রুর মোকাবিলা করছে। (১) মুদ্রাস্ফীতি যা আজ সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা এবং (৩) চোরাকারবারি, মুনাফাবাজ, মজুতদার ও ঘুষঘোর। এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে।’

যদিও তখনকার সময়ের তুলনায় এখনকার অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একট পোক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদিও আমন ধানসহ কিছু শস্যের ফলন অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। তবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি, আধুনিক বীজ, রাসায়নিক, কৃষকবান্ধব সরকারি প্রণোদনা আর কৃষিখাতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাবও অনেকটা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

তবে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় যে শত্রুর কথা বলেছিলেন সেই মজুতদার, ঘুষঘোরদের বিরুদ্ধে আজও যুদ্ধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। নিরন্নদের জন্য সরকারের বরাদ্দ ভাতে থাবা মেরে চলেছে দুর্নীতিবাজরা। মুনাফালোভী মজুতদাররা আজও সুযোগ বুঝে বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তাই সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে যাতে খাদ্যপণ্যের দাম থাকে সেজন্য সরকারি গুদামে খাদ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রাখতে হবে। যাতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ালেও সরকারি যোগানে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। অন্তত তিনবেলা মোটা চাল, ডাল ও সবজির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক ১৭ কোটির মানুষের খাবারের যোগান দিয়ে চলেছে তারাও যেন শ্রমের ন্যায্যমূল্য পায় সেই সুরক্ষাও দিতে হবে।

সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে যতদিন থাকবেন দেশে যত বড় দুর্যোগই আসুক না কেন তা সামলানো কঠিন কোনো কাজ হবে না। এটি কোনো আশাবাদ বা বিশ্বাস নয়, এটি বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি আস্থা। কারণ দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থই তার কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। এক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত তাদের সততা ও নিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: সাংবাদিক

মন্তব্য