জীবন-যাপন নির্বাচিত

মানসিক রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার


সুস্থতা বলতে শুধু দৈহিক সুস্থতাই বোঝায় না। একজন লোকের সুস্থতা বলতে তার শারীরিক মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতাকে বোঝায়। শারীরিক অসুস্থতায় যেমন মানসিক অশান্তি ঘটে, মানসিক অশান্তির জন্যে তেমন শারীরিক অসুস্থতা ঘটে থাকে। সুস্থতা বলতে তাই শরীর ও মন উভয়ের সুস্থতা বোঝায়। কেননা শরীর ও মন অভিন্ন।
প্রচলিত  ধারণায় যতক্ষণ কোনো লোক অস্বাভাবিক বা খাপছাড়া আচরণ না করে, ততক্ষণ তাকে মানসিক রোগী বলে মনে করা হয়না। কিন্তু খুব কম সংখ্যক রোগীর বেলায়ই অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়। এখনো আমাদের সমাজে মানসিক ব্যাধির কারণগুলোকে বিভিন্ন নৈসর্গিক শক্তির প্রভাব বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। সমাজে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস আছে যে জ্বিন-পরী, ভূত-প্রেতের খারাপ নজর পড়া বা আছর হওয়া, খারাপ হাওয়া লাগা,বায়ুর দোষ, তাবিজ করা, যাদু করা, প্রতিবেশীদের দ্বারা খারাপ কিছু খাইয়ে নষ্ট করা প্রভৃতির দ্বারা রোগ ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এ ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন। দেশে এবং বিদেশে জরীপ এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এ-সব আদি ভৌতিক বিশ্বাসের সঙ্গে মানসিক রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।

মানসিক রোগের কারণঃ

নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত কারণ বলে মনে করা হয়ঃ

১. পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যা, যেমনঃ দ্বন্দ্ববহুল, কলহময় পারিবারিক অশান্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।

২. ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যা, যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

৩.    বংশগত প্রভাব- যদিও মনে করা হয় যে বংশগত প্রভাবে মানসিক ব্যাধি হয়, তথাপি দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বংশগত প্রভাব অন্য কারণের সঙ্গে একযোগে কাজ করে।

৪. দৈহিক কারণ, যেমনঃ অল্প বয়সে পুষ্টিহীনতা, ভিটামিনের অভাব, শারীরিক অসুস্থতা, যেমন টাইওফয়েড,সিফিলিস, মস্তিষ্কের প্রদাহ, মস্তিষ্কে আঘাত ইত্যাদি এবিং বিষক্রিয়ার প্রভাব ইত্যাদি।

মানসিক রোগের প্রকারভেদঃ

মানসিক রোগ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন-
  ১.  দৈহিক (আঙ্গিক) কারণজনিত মানসিক রোগঃ
মস্তিষ্কে প্রদাহ, মৃগীরোগ(এপিলেপসী), ডিমেনশিয়া ইত্যাদি।
    ২. আভ্যন্তরীণ ও পারিপার্শ্বিক কারণ জনিত মানসিক রোগঃ
নিউরোসিস(স্নায়ুরোগ), মূর্ছা যাওয়া(সিস্টেরিয়া), সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিস্টারভেন্স ইত্যাদি
    ৩. মনো-দৈহিক (সাইকো সোমাটিক)ঃ
পেপটিক আলসার, হাঁপানি, চর্মরোগ, মাথা ব্যথা ইত্যাদি।

মানসিক রোগের লক্ষণঃ

মানসিক রোগের প্রধান লক্ষণগুলো হলোঃ

১. অতি-উত্তেজনাঃ চঞ্চলতা, প্রলাপ বকা, বিক্ষুব্ধ এবং আক্রমণাত্মক আচরণ প্রভৃতি উপসর্গ হতে পারে।
২. উদাসীনতাঃ চুপ হয়ে যাওয়া, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া না করা, একা একা বিড়বিড় করে কথা বলা কিংবা অকারণে নিজে নিজে হাসা।
৩. অশান্তিঃ বিষন্নভাবে থাকা, কিছু ভালো না লাগা, অস্থিরতা, অনিদ্রা,হাত পা এবং মাথায় জ্বালাপোড়া, নিজেকে অসহায় এবং ছোট মনে করা, আত্মহত্যার চিন্তা কিংবা প্রবণতা এবং অন্যান্য শারীরিক উপসর্গ।
৪. অতি – উদ্বেগঃ অস্তিরতা,বুক ধড়ফড় করা, বদহজম বা অরুচি, অকারণে ভীতি, দুর্বলতা, কম ঘুম হওয়া ইত্যাদি।
৫. যৌন -দূর্বলতাঃ বিভিন্ন যৌন দুর্বলতা জীবনে অনেক অশান্তির কারণ হয় এবং এ সম্পর্কে ভীতি সমস্যাকে আরো জটিল করে। কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা থেকে উদ্বগের জন্যেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এ রোগের সৃষ্টি।
ফিট হওয়াঃ দুই ধরণের ফিট হতে পারে
    মূর্চ্ছা যাওয়া( হিস্টিরিয়া)  যা মানসিক কারণে হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো মানসিক অশান্তির কারণ থাকে এবং কোনো ঘটনা বা অশান্তিকে কেন্দ্র করে ফিট হয়।
    মৃগী রোগ(এপিলেপসী) যা স্নায়ুবিক কারণে হয়। এ রোগী ফিট হলে তার শরীরে খিচুনি হতে পারে। রোগী সাধারণত অজ্ঞান হয়ে যেখানে সেখানে পড়ে যায় এবং শরীরে আঘাত পায়। ফিটের সময় প্রসাব হতে পারে। অনেকের মুখে ফেনা গড়ায়।

মানসিক রোগের চিকিৎসায় যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিতঃ

মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধ এবং পরামর্শ সমভাবে প্রয়োজনীয়। অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যা মানসিক ব্যাধির মূল কারণ হিসেবে থাকতে পারে। যেকোনো মানসিক ব্যাধিতে সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত কারণসমূহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা উচিত এবং তার সমাধান প্রয়োজন।

উল্লেখ্য,
    ১. অতি উত্তেজিত রোগীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে এবং পরিবারের লোকদের আশ্বাস দিতে হবে।
    ২. উত্তেজিত রোগীকে আবদ্ধ রাখা বা মারধর করা যাবে না। এটি ক্ষতিকর।
  ৩.  উদাসীন রোগীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে। প্রায় ক্ষেত্রেই চেষ্টা করলে রোগীকে খাওয়ানো এবং কোনো কাজে ব্যস্ত রাখা সম্ভব হয়।
   ৪.রোগী অশান্তিতে ভুগলে তার সঙ্গে কথা বলা, স্বান্তনা ও আশ্বাস দেওয়া প্রয়োজন।
   ৫. বেশিরভাগ মানসিক রোগী সুস্থ লোকের মতই স্বাভাবিক ব্যবহার করে থাকে। তাই মানসিক রোগীকে পাগল বলা উচিত না।

মানসিক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব কিঃ

আগেই বলা হয়েছে মানসিক রোগ দৈহিক কারণ ছাড়াও ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যা থেকে হয়। ছোটবেলা থেকে পারিপার্শ্বিক ও পারিবারিক পরিবেশ যদি কলহমুক্ত ও সুস্থ থাকে তবে মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ থাকতে অনেকখানি সহায়ক হয়। বিশেষ করে যদি কেউ নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে তবে অন্যান্য দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগজনিত মানসিক ব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

পুষ্টিহীনতা বা অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার প্রতি নজর দিলে অনেকাংশে মানসিক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং পরিশেষে কোনো রকম মানসিক ব্যাধির লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমাবস্থায় চিকিৎসা করলে এর পরিণাম অনেকাংশে শুভ হতে পারে।

মন্তব্য