অন্যান্য সাহিত্য

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৩


(পর্ব-৩)
বলে নেওয়া ভালো—নোয়াখালীর মূল ভূ-খণ্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মেঘনার মোহনা থেকে সদ্য জেগে ওঠা আমাদের এই গ্রাম—কেরামতপুর। আগেই বলেছি, যতদূর চোখ যায়, উত্তরে-দক্ষিণে-পশ্চিমে কেবল থই থই পানি। আর পূর্বে ছিল ঢেউ ঢেউ নদী—মেঘনা। এখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে বঙ্গোপসাগর। সাগর ফুঁসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই মেঘনার বুকও নীল তিমির পিঠের মতো ফুলে ফুলে ওঠে। আর পাড় উছলে গড়িয়ে পড়ে লোকালয়ে। লোকালয় বলতে প্রতি এক কিলোমিটারের মধ্যে হয়তো একটি বাড়ি। কখনো বা দুটি বাড়ি। বাড়িগুলো হয় পূর্বমুখী, না হয় পশ্চিমমুখী। প্রায় বাড়িতে দুটি ঘর। বসবাসের ঘরটির সাধারণত দুটি দরোজা, পূর্ব ও উত্তর-বা দক্ষিণ, কিংবা পশ্চিম ও উত্তর বা দক্ষিণমুখী এসব ঘর। আর বাকিটা রসুইঘর। এই ঘরটি সাধারণত দক্ষিণমুখী কিংবা উত্তরমুখী হয়। আর দুই ঘরের মাঝখানে থাকে একটি উঠোন। এর নাম ছোট উঠোন। আর পূর্ব বা পশ্চিম পাশে বসবাসের ঘরের সামনেও একটি উঠান থাকে। সেই উঠানটিকে বড় উঠান বলা হতো। এসব বাড়িতে তেমন গাছপালা নেই, নেই তেমন শক্ত ভিতের কোনো ঘরও।

প্রতিটি বাড়িতে দুই-তিনটি করে ঘর। নাড়ার ছাউনি, হোগলাপাতা বা নলখাগড়ার বেড়া। সামান্য বাতাস হলেই শোঁ শোঁ করে ঘরে ঢুকে পড়ছে বাতাস। দিনের বেলায় বিষয়টি যথেষ্ট উপভোগ্য হলেও রাতে ঘুমানোর আগপর্যন্ত বিষয়টি যন্ত্রণার। হয়তো গৃহস্থেরা ভাতের থালা, পাশে খেসারি ডালের ঢেলা কিংবা পাটশাকের তরকারি কিংবা নদী থেকে ধরে আনা মাছ নিয়ে খেতে বসেছেন মাত্র, অমনি শোঁ শোঁ করে বাতাস এসে জলদস্যুর মতো হানা দিলো। তখন আর কী, ধপ করে নিভে গেলো কেরোসিনের চেরাগ। বউ-ঝিয়েরা এঁটোহাতে ম্যাচ কিংবা গন্ধকমাখা পাটখড়ি ও আগুনের বরশি খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। কখনো মুহূর্তমাত্র, গন্ধকমাখা পাটখড়ির মাথা আগুনের বড়সিতে ডুবিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠছে নীলচে আগুন। আর তখন কেরোসিনের চেরাগেও ফিরে এলো আলো। কোনো কোনো অবস্থাপন্ন ঘরে চেরাগের পরিবর্তে ছিল হানস। চারকোণা হানস। চারকোণা বাক্স। বাক্সটির চারদিকে কাচের গ্লাস।ওপরে ও নিচে টিনের পাত। এদিকের কাচ ওপরের দিকে ঠেলে ধরে ভেতরে মাঝখানে চেরাগটা বসিয়ে দিতে হতো। তারপর কাচ নামিয়ে দিলেই হলো। খুব ঝড়োবাতাস না হলে সেই চেরাগ নিভতো না।

শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটানা অ্যা…অ্যা…অ্যা করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মায়েরা সেই কান্না থামাতে না পেরে হয়তো কেউ শাক সেদ্ধ করে খেতে দিচ্ছেন, নয়তো কষে গালের ওপর বসিয়ে দিচ্ছেন চড়।

তোরাব আলী গ্রামে বেশ কয়েকদিন ধরে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। কোনো কিছু দিয়েই সেই ফুটো বন্ধ করা যাচ্ছিল না। টানা চৌদ্দদিন ধরে নতুন বউয়ের ঘোমটার মতো লাজনম্র মেঘমালা নেমে আসে গাছপালার মাথার ওপর। আর দিনমান ঝরিয়ে যাচ্ছে সেই বউয়ের চোখের জল। আর তাতেই মাঠঘাট-রাস্তা থই থই করছে। গ্রামের পুরুষরা হাটবাজারে যেতে পারছে না, জেলেরা মাছ ধরে আনছে বটে, কিন্তু সেই মাছ সাত মাইল পশ্চিমের চরবাটা ছমির হাটে নিয়ে বেচবে, সেই জোটুকু নেই। তাই ঘরের বারান্দায়, রান্নাঘরের চুলার ওপর সেই সব মাছ পচতে থাকে, শুকাতে থাকে। কোনো কোনো ঘরে চাল নেই। শিশুরা ক্ষুধার তাড়নায় শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটানা অ্যা…অ্যা…অ্যা করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মায়েরা সেই কান্না থামাতে না পেরে হয়তো কেউ শাক সেদ্ধ করে খেতে দিচ্ছেন, নয়তো কষে গালের ওপর বসিয়ে দিচ্ছেন চড়।

এমনি এক প্রবলবর্ষণের বিকেলে বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে এলো। এগোরো নম্বর মহাবিপদ সংকেত। আর মাঝেমাজে গান। ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে…। এবারও বাবা বাড়িতে ছিলেন না। ব্যবসায় উপলক্ষে ছিলেন চট্টগ্রাম। বাড়িতে মা আর আমরা দুই ভাই। তো সেদিনের মতো ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা ঘুমোতে গেলাম।

রাতে আমাদের ঘরের একটি চাল উড়ে গেয়ে ঝড়ে।  সারাঘরে পানির স্রোত। ঝড়ের তাণ্ডব, নদীর পানির গর্জন, সব মিলিয়ে প্রলয়কাণ্ড।  দেখতে না দেখতে আমাদের উঠোন ডুবে গেলো পানিতে। উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ভেসে যাচ্ছে কারও ঘরের চাল। কারও চৌকির কাঠ। কারও বা অনেক যত্নে বানানো কুলা। আহ কত রঙ-বেরঙের সেই কুলা। ভেসে যাচ্ছে পাটের তৈরি শিকা। সঙ্গে হাতপাখা। তাতে তাতে রঙিন সুতোয় লেখা—‘ভাই বড় ধন/রক্তে বাঁধন।’ এই বানভাসি গ্রামের যে দিকে তাকাই জল আর জল। কোথাও জনমানব নাই। হঠাৎ করে কোনো একটি বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে আসে, বৃদ্ধকণ্ঠের—‘ওরে আল্লাহরে ছাগল ভাসি গেছে গই! অন কী অইবোরে?’

আমরাও ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁদে উঠলাম। কিন্তু কেন সেদিন তিনজনেই অমন কাঁদলাম, সে প্রশ্ন কখনো মাকে করা হয়নি, না নিজেরাও কোনোদিন নিজেদের করেছি।

এসব চিৎকার আহাজারি শুনে চলেছি। এদিকে বেলা বাড়ছে। তীব্রক্ষুধায় আর থাকতে পারছি না। মাকে বললাম, ভাত খাবো। মা কিছু বললেন না। খাবার রুমে গিয়ে দেখি হাঁড়িতে ভাত নাই। রসুইঘরে দেখি চুলা ডুবে গেছে। খাব কী? ঘরে শুকনো কোনো ম্যাচও নেই। আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। মায়ের চোখে জল। কিন্তু কিছু বলছেন না। আমরা দুই ভাই চিৎকার করে কাঁদছি। মা হঠাৎ করে কষে এক থাপ্পড় বসালেন। তাতে আমি চুপ হয়ে গেলেও, আমার তিন বছরের ছোট ভাইটির কান্নার আওয়াজ তিনগুণ চড়া হয়ে গেলো।

এবার আমি খুঁজতে লাগলাম ঘরে কী পাওয়া যায়। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম অনেক দিনের পুরনো একটি বেলা বিস্কুট। চার আনা দাম। বিস্কুটটি পেয়ে ভাইকে ডাকলাম। সে এলো। বললাম, থালা আন। আনলো। বললাম, থালায় একমগ পানি ঢাল। সে ঢাললো। বিস্কুটটি সেখানে ভিজিয়ে রাখলাম অনেকক্ষণ।  একসময় নরম হয়ে গেলো। এরপর কচলে কচলে পুরো পানিতে বিস্কুটের শরবত বানিয়ে নিলাম। দুই মগে সমানভাবে দুই ভাগ করলাম। করে একভাগ ভাইকে দিলাম, অন্যভাগ আমি নিলাম। মা দেখে মুখ টিপে হেসে অন্য রুমে চলে গেলেন।

ওই টুকু শরবত খেয়ে ক্ষুধা যেন আরও বেড়ে গেলো। এই যেন প্রায় নিভন্ত আগুনের ফুলকির ভেতর কেরোসিন ঢেলে দিলাম।  ছোট ভাই আমাকে টেনে নিয়ে গেলো আবারও উঠোনে। গিয়ে দেখি আমাদের জন্য মহাবিস্ময় অপেক্ষা করছে। শত শত সাগরানা আলু (মিষ্টি আলু) ভেসে যাচ্ছে। আমাদের আর পায় কে? ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। লুঙ্গি ভরে তুলে আনলাম ইচ্ছামতো। ভালো করে টানা কলের পানিতে আলুগুলো ধুয়ে নিলাম। এরপর শুরু করলাম কাঁচা আলু খাওয়া। সে কী মিষ্টি। জীবনে এত মিষ্টি ফল কিংবা কোনো খাবার আর খেয়েছি কি না, আজও মনে করতে পারি না। আমাদের দুই ভাইয়ের আলু খাওয়া দেখে মা এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাও করে কেঁদে উঠলেন। আমরাও ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁদে উঠলাম। কিন্তু কেন সেদিন তিনজনেই অমন কাঁদলাম, সে প্রশ্ন কখনো মাকে করা হয়নি, না নিজেরাও কোনোদিন নিজেদের করেছি।

পড়ুন আগের পর্ব:
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-২

চলবে…

মন্তব্য