অন্যান্য সাহিত্য

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৬


[পর্ব-৬: মাদ্রাসা পর্ব]

সেদিন মরিয়মের কটাক্ষে আমার ভেতরও জিদ চাপলো। নির্বাচন কমিশনার আবার কী জিনিস?  কাকে জিজ্ঞাসা করি? কার কাছে পাবো এর উত্তর।  আমার দুই বন্ধু চেয়ারম্যান প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি কী করে দুজনেরই পক্ষে থাকবো? আবার কারও পক্ষেও না? এটা কী করে সম্ভব? মরিয়ম আমাকে কী ধরনের ধাঁধায় ফেলে গেলো, ভাবতে ভাবতে আমার রাতেই খাবারই গলা দিয়ে নামে না। পিঁড়ি পেতে খেতে বসেছি দুই ভাই। ইসমাইল বললো, এত কী ভাবছ? খাছ না ক্যা? প্রতি-উত্তরে বলি—ক্ষুধা নাই রে।  ইসমাইল আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসে। বলে—তোর মতো রাক্ষসের ক্ষুধা নাই? প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই আবার খিকখিক করে হাসে। এবার মা ক্ষেপে গেলেন—কী শুরু করলি তোরা? ভাত খা তারাতারি। খেয়ে-দেয়ে ঘুমাতে যা।

ঘুমোতে এসে উসখুস করি। ইসমাইলকে বলি, তু-তু-তুই জানোসনি নি-নি-নির্বাচন কমিশনারের কাজ কী? কী করে? সে বলে, এত ভাবার কী আছে? কাল মরিয়মরে জিগাইলেই তো অয়। এত ভাবছ ক্যা? মনে হয় দেশের রাজাই অই যাবি, হেয় টেনশানে তোর ভাত নামে না গলা দিয়া। আবার ঘুমও অয় না। যা তুই ঘুমালে ঘুমা, না ঘুমালে নাই। আঁই ঘুমাইলাম।

ইসমাইল ঘুমিয়ে পড়লো। আমার আর ঘুম আসে না। কী এক আজব কথা শোনালো মরিয়ম—নির্বাচন কমিশনার! ভাবতে ভাবতে একসময় সত্যিই ঘুম এসে গেলো।

বাবারা সন্তানের অস্তিত্বে সর্বক্ষণ বিরাজ করেন। সারাক্ষণই ছায়া হয়ে সন্তানকে পাহারা দেন। কেউ টের পায়, কেউ পায় না।

কপাল কেটে যাওয়ার ক্ষত তখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। তাই তাই মাদ্রাসায় যায় না। বাড়িতে মাঝেমাঝে রেওয়াজ করি। ভোরের দিকে। সেদিন আর কোরআন তেলাওয়াতে বসলাম না। রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কেটে যাওয়ার  আগেই ঘর থেকে বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে বের হলাম। ঘরে পেছন দিক দিয়ে উঠলাম পুকুর পাড়ে। যাবো মরিয়মদের বাড়িতে। নির্বাচন কমিশনার আসলে কী, ভালো করে বুঝে নেবো তার কাছে। পুকুরের দক্ষিণ পাড় ঝোপজঙ্গলে ভরা। হাঁটা যায় না। বাবা বলেছিলেন, সেখানে নাকি সাপে-বেজিতে প্রায় যুদ্ধ হয়। হাঁটতে গিয়ে বাবার কথা বারবার মনে হচ্ছিল। বাবারা সন্তানের অস্তিত্বে সর্বক্ষণ বিরাজ করেন। সারাক্ষণই ছায়া হয়ে সন্তানকে পাহারা দেন। কেউ টের পায়, কেউ পায় না। আমার দশাও তাই। তখন আরও ভয় পেয়ে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ যেন পায়ের তলায় পিচ্ছিল-শীতল কিছু একটা পড়লো। নিচের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। কী করি, কী করি—ভাবতে না ভাবতে লাল পিঁপড়ার সারি পা বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। পিঁপড়ার মিছিল থামাতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ে গেলাম। জামা কাপড়ে পচা-গলিত কলাপাতা লেগে একাকার্। আর তখনই আবিষ্কার করলাম, পায়ের তলায় অর্ধেক পচা কলাপাতাই পড়েছিল। বুকে তিন বার থুতু দিয়ে ফের হাঁটা শুরু করলাম।

এবার আর কোনো ভয় নেই। অনেকটাই বীরদর্পে হাঁটছি। খরগোসের মতো কান খাড়া আমার, দৃষ্টিও বাজপাখির মতো। অনেক দূরের বস্তুও দেখতে পাই। তাই হন হন করে ঝোপঝাড় ভেঙে হেঁটে চলেছি। দশ বারো ফুট যাওয়ার পর আবারও বুকের কাঁপন শুরু। পা আর চলে না। পেছনেও সরতে পারি না। সামনে তো নয়ই।  আমার দিকে একটি গোখরো ফনা তুলে আছে।  চিৎকার দেবো? নাহ? ঠিক হবে না। তাহলে পিঠের ওপর বাবার বেতের বাড়ি একটাও  বাদ যাবে না। দৌড় দেবো? পা তো চলে না। নাড়াতে পারি না। বহুযুগের শাপগ্রস্ত কোনো এক স্থবির পাহাড়ের মতো আমার দুই পা অবস হয়ে গেছে। তাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি। দোয়া-দরুদ কিছু কি পড়েছিলাম তখন? মনে পড়ছে না। তবে বারকয়েক আল্লাহর নাম নিতে গিয়ে দেখি, তোতলামির কারণে তাও স্পষ্ট বের হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পরই ঘটে গেলো অলৌকিক ঘটনা। সাপটার পেছন থেকে একটি বেজি এসে লেজ কামড়ে ধরলো। অমনি সাপটিও বেজিটিকে দিলো ছোবল। একপর্যায়ে পুরোবেজিটিকে সাপ তার কুণ্ডুলিবন্দি করে ফেললো। সাপে-বেজিতে কুণ্ডুলি পাকাতে পাকাতে পাড় থেকে পুকুরের চাতালের (পুকুর গভীর অংশের ওপরে দিকে, পাড়ের কাছাকাছি, শীতকাল আসতে আসতে সাধারণত সেখানে পানি থাকে না) দিকে গড়িয়ে পড়লো। এবার আমার পা যেন চেতনা ফিরে ফেলো। আমি রুদ্ধশ্বাসে দিলাম দৌড়। একদৌড়ে পুকুর পাড় থেকে ধানক্ষেতের আল ধরে মরিয়মদের পুকুর পাড়। তাদের নতুন বাড়ি। পাড়ে কোনো গাছপালাও নেই। নতুন মাটি। ঠিক মাটি নয়। ধুলো আর ধুলো। সেই ধুলো হাওয়া উড়িয়ে হাজির হলাম ঘরের সামনে। বাইরে থেকেই ডাক দিলাম ‘ম-ম-ম-মরিয়াম’ ওই ‘ম-ম-ম-মরিয়াম’। কোনো সাড়া নেই। কিন্তু মুহূর্তেই দরোজা খুলে গেলো।

কিন্তু এখন তো দেখছি সূর্য  আসলে মক্কা থেকে ওঠে না! ওঠে আমাদের বাড়ির পেছনে সিকি মাইল দূরের মেঘনার পানি থেকেই।

দরোজা খুলে যিনি বেরি এলেন, তিনি মরিয়মের মা। এই মহিলার গায়েপড়া স্বভাব আমার ভালো লাগে না। গ্রামের অন্যান্য মহিলা—যারা আমার মা-খালার বয়সী তারা আমাকে বোনপুত বলেই জ্ঞান করে।  আমার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু এই মহিলাকে আমি খালা ডাকলেও তিনি আমার নাম ধরে কখনোই ডাকেন না। ডাকেন একটি ‘বিশ্রী’ শব্দে। তো আমাকে এত ভোরে দেখেই একগাল হেসে উঠলেন—জামাই ক্যান আইছো? মরিয়মরে তুমার মা যাইতে কইছে? বসো বসো, ডেলায় (ঘরের সরু বারান্দা) উঠে মোড়ায় বসো।

আমাকে বসতে দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। এবার চাপা স্বরে ডাকছেন নিজের মেয়েকে—‘মরিয়ম, ও মরিয়ম। উঠ। দ্যাখ দ্যাখ জামাই আইছে। আবুর (ছোটদের তিনি আবু বলতেন। আমাকেও।) মা তোরে মনে হয় যাইতে কইছে। আহারে বেচারির কোনো মাইয়া নাই। তোরে কত্ত আদরে করে। উঠ উঠ। তাড়াতাড়ি জামাই’র লগে যা।’

এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। এদিকে পূর্বাকাশের তলে মেঘনার বিপুল জলরাশির নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে টকটকে লাল-গোল একখানা বিশাল থালা।  থালার চারপাশে যেন আরও হালকা রঙের কয়েকটি বৃত্ত। সেই বৃত্ত থেকে রঙ যেন ঠিকরে পড়ছে পানিতে।  আমার চোখে বিস্ময়। এমন করে প্রতিদিন সূর্য ওঠে এই নদী থেকে?  তাহলে যে মাদ্রাসায় আমরা গজল শুনি—‘মক্কা থেকে ওঠে রবি মদিনায় যায় ডুবে’ তা কি মিথ্যা? শুনেছি—মক্কা-মদিনা  আমাদের বাড়ি থেকে পশ্চিম দিকে। কত পশ্চিমে, তা জানি না। ইসমাইল আর মাহফুজ বলেছে, অনেক দূর। হেঁটে-হেঁটে বা গরুর গাড়িতে যাওয়া না। এমনকী মাইজদী শহর থেকে আমাদের বাংলাবাজারে কচ্ছপের মাথাঅলা যে বাস আসে, সেই বাসেও নাকি মক্কা-মদিনায় যাওয়া যায় না! এতদিন ভাবতাম—মক্কা-মদিনায় যেতে পারলে হয়তো সূর্য ওঠা-ডোবার দৃশ্য কাছ থেকে দেখতে পাবো। সূর্য কোথায় থাকে, তার ঘর কেমন তাও দেখতে পাবো। কিন্তু এখন তো দেখছি সূর্য  আসলে মক্কা থেকে ওঠে না! ওঠে আমাদের বাড়ির পেছনে সিকি মাইল দূরের মেঘনার পানি থেকেই। মরিয়মদের ঘরের ঢেলায় বসলেই দেখা যায়। সূর্যের ওঠা দেখার জন্য মক্কা যাওয়ার দরকার হয় না।

কী জ্বালায় পড়লাম!

মরিয়মদের বাড়িতে এলাম, নির্বাচন কমিশনার কী, তা জানতে। ওর মা বুঝলেন আরেকটা। মরিয়মকে ঘুম থেকে তুলে পাঠাচ্ছেন আমার মায়ের কাছে। আমাকে দেখামাত্রই জামাই জামাই করে বিরক্ত করলেন। মহিলা জানেন, জামাই বললে আমি লজ্জা পাই। একে তো তোতলামির জন্য সহজে কথা বলতে পারি না, তার ওপর এমন আচরণে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আজও হলো। কিন্তু কিছু বলতে না পারায় কপালের দুই পাশের সরু পেশীতে টনটন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। সঙ্গে চোখ দিয়ে পানিও বের হচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে দুই চোখে। মনে হচ্ছে চোখ দুটি এখনই ঠিকরে বেরিয়ে যাবে। মাথার ভেতর অনেক চিন্তা। ‘নির্বাচন কমিশনার’, ‘সূর্যের উদয়াস্তের স্থান’, ‘জামাই সম্বোধন’—এসবের সমীকরণ মেলাতে পারছি না।  সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে, মাথার ভেতর প্রতিটি তন্ত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি বোধ হয় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবো। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মরিয়মের ডাকে সম্বিত ফিরে এলো—কী রে কী ভাবোছ? এত বেহেন্না আঙ্গো বাড়িত?

তাই দ্রুত পা চালালাম বাড়ির দিকে। আর আমার মতে হতো লাগলো—তাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি মক্কা-মদিনার চেয়েও দূরে সরে যাচ্ছে। সেই পথ যেন অনন্তকালের পথের চেয়ে দীর্ঘ। কিছুতেই ফুরাতে চায় না আর!

কী বলবো—বুঝতে পারছিলাম না। এতগুলো বিষয় মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, কেন এসেছি, তাও ভুলে গেছি। এবার মরিয়ম খোঁচা দিয়া বলে, মায় তোরে জামাই কয় ক্যান বুঝোচ? আমি ‘না-সূচক মাথা নাড়ি। মরিয়ম মুচকি হেসে কয়, বড় অইলে তোর লগে আমারে বিয়া দিবো। তোর মায়ের লগে মায় বেহাইন পাতাইছে। তুই জানোস না?

এবার আমার মেজাজ সত্যি খারাপ হয়ে গেলো—কীককককী কসসসসস এসব? ফাজজজজলামি পাইছসসসসসস? যাহ! তো তো তোগো বাড়িত আআআরর বসমুই না। অমনি মরিয়মের মা এসে আমার মাথাটা বুকের ভেতর চেপে ধরে বলেন, আমার আবু সোনা, কে কী কইছে তোরে? হের বিচার আমি করুম। তুই এখন নাস্তা করবি।  রুটি, ডাল, ডিম। তারপর বাড়িত যাইবি। আমিও যামু তোর লগে। তোর মা কিল্লাই পাঠাইছে এত বেহেন্না তোরে?

আমি আদরে এতই গলে গেলাম যে, খানিক আগের ক্ষোভ ভুলে গেলাম। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললাম, আম্নে জা-জা-জামাই কন, ঠি-ঠি-ঠিক আছে। আবার আম্নের মাইয়াও আঁরে জাজাজাজামাই কয়। কিল্লাই? হেতির কি ল-ল-ল-লজ্জ-শ-শ-শরম নাইনি? মরিয়মের মা বলেন, আইচ্ছা আর কইতো ন। এবার ক তো বাপ, তোর মা তোরে এক বেহেন্না কিল্লা পাঠাইছে?

বললাম, আম্মা তো পাঠায় ন, আঁই নি-নি-নিজে আইছি। ইউসুফ আর জাফরিয়া ভো-ভো-ভোটে খাড়াইবো। চে-চে-চেয়ারম্যান অইবো হেতারা একজন।  মরিয়ম কইছে, আঁই য্যান নি-নি-নির্বাচন কমিশনার হই। অহন আঁই তো বুঝি না, নি-নি-নির্বাচন কশিনার কা-কা-কারে কয়? আমার কথা শুনে মরিয়ম খিক-খিক ওঠে—ওরে তোতলা। তোরে কিচ্ছু বুঝন লাইগতো ন। নির্বাচন কমিশনার হইলো, নির্বাচন কমিশনার। মানে ভোটের জজ। ভোটাররা বেগগুনে হেতার কাছে ভোট দিবো। হেতে ভোট গুনে দেখবো কে বেশি ভোট পাইছে। হের পর হেতে ঘোষণা কইরবো কে জয় পাইছে, কে হেরে গেছে? হেতার সিদ্ধান্তই আসল। ভোটের বেলায় হেতার উপ্রে কারও কথা চলে না। তুই হইলি হেই ক্ষেমতাওয়ালা লোক। তোরে তো এমনিতেই বেগগুনে ডরায়। হেয় কথারলাই তোরে আমি নির্বাচন কমিশনার বানাইতে চাইলাম। এবার বুইঝঝততি জামাই?

এতক্ষণ মরিয়ম যা বলছিল, একান্ত অনুগত ছাত্রের মতো শুনছিলাম। কিন্তু শেষ শব্দটি আমার কানের ভেতর আবারও যেন গরম সিসা ঢেলে দিলো। একঝটকায় মরিয়মের মায়ের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় মরিয়ম একটুও ভড়কে গেলো না। সে বরং ফিক করে হেঁসে দিলো।  আবারও ভ্যাংচি কটে বললো—ওই তো-তো তোতলা তুই কিন্তুক আমার জামাই! কথা শুনে তার মাও হিহিহি করে হেসে উঠলেন! আর সেই হাসির প্রতিটি ধ্বনি যেন আমার কানে একেকটি বর্শার ফলা হয়ে ঢুকছিল। তাই দ্রুত পা চালালাম বাড়ির দিকে। আর আমার মতে হতো লাগলো—তাদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি মক্কা-মদিনার চেয়েও দূরে সরে যাচ্ছে। সেই পথ যেন অনন্তকালের পথের চেয়ে দীর্ঘ। কিছুতেই ফুরাতে চায় না আর!

চলবে…
জীবনের যতিচিহ্নগুলো-৫

মন্তব্য