অন্যান্য সাহিত্য

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১১


[পর্ব-১১: মুক্তবিহঙ্গ অথবা রাখাল পর্ব]
তখন শরৎকাল এসে গেছে। এই সময় এলে ধানগাছগুলো বেশ বড় হয়ে যায়। দখিনা বাতাস ঢেউ খেলে যায় ধানপাতাগুলোর ওপর দিয়ে। সব জায়গায়ই দেখি বাতাসের রাজত্ব। কদিন আগেই তো দেখলাম, বর্ষায়। ভরা বর্ষায়ও থই-থই পানিতে বাতাস ঢেউ খেলে গেলো। ভরা বর্ষায় পানির ঢেউয়ের তালে-তালে আমাদের হাসের ছানাগুলোও তখন ভাসতো। আমরা বাড়ির আড়া-কাঁদির ওপর বসে বসে দেখতাম। আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে বেশি যেতে পারতো না। গেলে অমনি ‘আয় আয় তই তই তই তই’ করে ডাকতাম। আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা হাসের ছানাকে ডাকতো, ‘আয় আই তি তি তি তি’ করে। আমরা যেভাবেই ডাকি না কেন, হাসের ছানাগুলো ঠিকই সাড়া দিতো। অমনি প্যাক-প্যাক করতে করতে আমাদের কাছে চলে আসতো।

আর এই শরতে হাসগুলোকে দেখা যায় না। হাসগুলো বড় হয়ে গেছে। আগে ছোট ছোট শামুক খেতো। এখনও খায়। সঙ্গে খায় ধানের গোছার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ছোট-ছোট মাছ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে না ডাকতেই খোয়াড়ের কাছে এসে প্যাক-প্যাক করে। আমরা ধরে ধরে খোয়াড়ে তুলে দেই। খোঁয়াড় আবার দুই ধরনের। প্রথমত মাটির। তাও রান্নাঘরের এককোণে বসানো হতো। দ্বিতীয়ত উঠোনের এককোণে উঁচু মাচানের ওপর। দোচালা ছোট্টঘর। দুটোতেই বিপদ। বাঘডাস ও শেয়াল। রাত নিঝুম হয়ে এলেই হলো। অমনি এক বাড়ি থেকে মুরগির ক-ক-ক শব্দ ভেসে আসে তো, অন্য বাড়ি থেকে ভেসে আসে হাসের প্যাক প্যাক আওয়াজ। সঙ্গে গৃহস্থের ছু-ছু, কুকুরের ঘেউ ঘেউ।

তারপর বিমর্ষ মুখে মেজ খালার দিকে ফিরে বললেন, ‘মরিচের মতোন টকটকা লাল রাতাটা খাসি করাইছিলাম। তোর জামাই আইলে খাওয়ামু। কাইল তো তোর জামাই আইবো। আঁই অন কী করুম?’

এই ঘটনা নিত্য। গা-সওয়া। তবে একবার ভারি মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমার মেজ খালা এলেন নানার বাড়ি। মাদ্রাসা পালিয়ে যার বাড়িতে উঠেছিলাম। সঙ্গে এলো তার বাঘা। পোষা কুকুর। তার সামনে খাবার ফেলে রাখলেও সে খাবে না। বিস্কুট বা পিঠার টুকরো; কোনোটাই না। যে-ই খালা বলবেন, ‘আ-তু-তু। বা…ঘা। নে খা।’ অমনি কুঁই-কুঁই করতে করতে প্রথমে লুটিয়ে পড়বে। তারপর বারকয়েক ডিগবাজি খাবে। এরপর শুরু করবে খাওয়া। আমরা সবসময় দেখে এসেছি কুকুরকে ভয় পায় বেড়াল। কিন্তু বাঘার বেলায় শুনি উল্টো গীত। শুনি কী, দেখিও। নানাবাড়ির বিশালকায় হুলো বেড়ালটাকে দেখলেই বাঘা কেমন যেন ভয়ে কুঁচকে যেতো। বিষয়টি খুবই মজার ছিল। আমরা মাছের কাঁটা, গরম ভাত উঠোনের মাঝখানে বাঘার সামনে এনে রাখতাম। বাঘা খেতো না। সেদিন হলো কী, আমরা; মানে আমি আর ছোট খালা মিলে উঠোনে মাছের কাঁটা, গরম ভাত রেখে দিলাম। মেজখালা বাঘাকে ডাকলেন—‘নে বাঘা, খা।’ অমনি বাঘার রঙ-ঢঙ শুরু হয়ে গেলো। বারকয়েক ডিগবাজি খেয়ে খাবারে মুখ দিয়েছে মাত্র। ছোট খালা তার বেড়ালকে দিলো ডাক—‘মিনি-মিনি।’ মিনিও এসে হাজির। বাঘাকে গরম ভাত-মাছের কাঁটা খেতে দেখে সে কী কেশর-লেজ ফুলিয়ে গর্জন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাঘার গায়ে আঁচড় বসিয়ে দিচ্ছে। বাঘা পরাজিত রাজার মতো, মাথা নিচু করে, লেজগুটিয়ে পিছু হটতে হটতে মেজ খালার পায়ের কাছে সেজদায় পড়ে গেলো। আর মিনি দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার সেজে মগ্ন হলো খাবারে।

সেই রাতেই ঘটলো আরেক মজার ঘটনা। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ মুরগির খোয়াড় থেকে ক-ক-ক-ক শব্দ ভেসে এলো। নানি-মেজ খালা—দুজনেই জেগে গেলেন। গন্ধক মাখা পাঠখড়ির মাথা ডুবিয়ে দিলেন তুষের আগুনের বড়শিতে। অমনি নীলচে আলো জ্বলে উঠলো। হাতের কাছেই ছিল চেরাগ। সেই আগুন চেরাগে সংযোগ দিতেই ঘরের অন্ধকার কেটে গেলো। আমাদের ঘুমচোখ। গন্ধকের গন্ধ নাকে লাগতেই কেমন যেমন মাথা ঘুরে উঠলো। তার টাল সামলানোর আগেই আলো জ্বলে ওঠায় চোখ সহ্য করতে পারছিল না। কোনো কথা বলার আগেই মেজ খালা চিৎকার দিয়ে উঠলেন—‘বা…ঘা।’ বাঘাও সাড়া দিলো—‘ঘেউ-উ-উ-উ।’ ততক্ষণে শেয়াল খোয়াড় থেকে মোরগ নিয়ে দে ছুট। মোরগের ক-ক-ক আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনে খালা বুঝে নিলেন, শেয়ালটা দক্ষিণ দিকেই যাচ্ছে। অমনি সেদিনে আঙুল তুলে বাঘাকে বললেন, ‘ছু-ছু-ছু। যা বাঘা মোরগ নিয়ে আয়।’ বাঘা দাঁড়িয়ে ছিল উঠোনের মাঝখানটায়। মেজ খালার নির্দেশ পাওয়ামাত্রই দুই লাফেই উঠান পার। এরপর দে ছুট।

নানি একবার খোয়াড়ে চেরাগের আলো ফেললেন। তারপর বিমর্ষ মুখে মেজ খালার দিকে ফিরে বললেন, ‘মরিচের মতোন টকটকা লাল রাতাটা খাসি করাইছিলাম। তোর জামাই আইলে খাওয়ামু। কাইল তো তোর জামাই আইবো। আঁই অন কী করুম?’ মেজ খালা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘মা। চিন্তা করিয়েন না। বাঘা ঠিকই ধরি নিয়ে আইবো’। খালা কিছুক্ষণ পরপর, ‘বাঘা, আ-তুতু’ বলে ডাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। আমাদের বিরক্ত লাগে। অন্ধকার রাতে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ধরে আসে। কোথায় বাঘা খাসি মোরগ নিয়ে ফিরে আসবে, তারই তো দেখা নেই। এবার ছোট খালা বললেন, ‘চল ঘুমাই।’

ছোট খালা বললেন, ‘ঢঙ্গি কুত্তা!’এরপর মুখে একটা ঝামটা মেরে ঘরের পথ ধরলেন।

সকালে আমাদের ঘুম ভাঙলো ছোট খালার ডাকে। হন্তদন্ত গলায় ডাকছে, ‘ও আপা, ও মা উডেন। আইয়েন বাঁশতলায়। দেখেন কী কাণ্ড!’ তার কণ্ঠে উদ্বেগ না উদ্বেল, কিছুই বুঝলাম না। চোখ ঢলতে ঢলতে বাঁশতলায় গিয়ে হাজির হলাম। আমার তো বিস্ময়ে ঘোর কাটে না। খাসি মোরগের দুই পায়ের ওপর নিজের সামনের দুটি পা দিয়ে চেপে ধরেছে বাঘা। আর ঝুটিটা আলতো করে কামড়ে ধরেছে। তার সারা শরীরে লাল পিঁপড়ায় ছেয়ে গেছে। অসংখ্য পিঁপড়া। কোনোটা কোনোটা কুটুস করে কামড় দিচ্ছে। কোনো কোনোটা কানের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কুটুস করে কামড়ের যন্ত্রণায় বাঘা কুঁই-কুঁই করে উঠছে। আর কানের ভেতর ঢুকতে চাইলে সজোরে কান ঝাড়া দিয়ে উঠছে। তবু মোরগ ছাড়ছে না।

মেজ খালাকে দেখেই বারকয়েক চোখ পিটপিট করলো। খালা কী বুঝলেন, জানি না। দ্রুত এগিয়ে গেলেন। আলতো করে মোরগটাকে ছাড়িয়ে নিলেন। নানি কাছেই ছিলেন। দিলেন তার হাতে। বললেন, ‘নেন আম্নের জামাইয়েরলাই চিন্তা করন লাইগতো ন। বাঘা আছে না? আঁর শিকারি বাঘা। বেঈমান নয়। পাক্বা ঈমানদার।’ প্রশংসা শেষ হতে না হতেই বাঘা এবার মেজ খালার পায়ের কাছে সেজদায় পড়ে শুরু করে দেয় কুঁই কুঁই।  তাই দেখে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠি। আমাদের হাসিতে যেন বিরক্ত হলেন ছোট খালা। সঙ্গে তার বেড়াল মিনিও। ছোট খালা বললেন, ‘ঢঙ্গি কুত্তা!’এরপর মুখে একটা ঝামটা মেরে ঘরের পথ ধরলেন।

বাঘাকে দেখলেই যে মিনি বাঘের মতো হুঙ্কার ছাড়ে, আজ যেন বদলে গেলো তার আচরণও। লেজগুটিয়ে ছোট খালার পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো। বাঘার সেদিকে খেয়াল নেই। সে কেবল মেজ খালার পায়ে সালাম দিতেই ব্যস্ত। খালা বললেন, ‘চল তোরে বিস্কু খাইতে দিমু।’

সেদিন দুপুরে খালু এলেন। তার জন্য রান্না হলো সেই খাসি। ডানা-ঠ্যাং-চামড়া—এসব দিয়ে রান্না হলো গোল আলু। আরও ছিল পুকুর থেকে তোলা কাতলা মাছ। তেলাপিয়া। কই ভাজা। মেজ খালু আর মামা খেতে বসেছে সামনের রুমে। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে। তার ওপর দেওয়া হয়েছে দস্তরখান। খালু ও মামার খাওয়া শেষ হলে নানা-নানি-মেজ খালা, ছোট খালা ও আমি খেতে বসি খাওয়ার রুমে। নিচে পিঁড়ি পেতে। নানার সামনে খেতে বসার ঝক্কি আছে। একটি ভাত মাটিতে পড়তে পারবে না। অমনি মাথার পেছন দিকে টিপে ধরে বলবে, নে। ধুয়ে খা। এই ভাত একদিন আখেরাতে সাক্ষ্য দিবো। তুই তারে হেলা করছস। পানি খাওয়ার সময় একঢোকে খাওয়া যাবে না। বলবেন, ‘তিন ঢোকে খা।’ শুধু বাম হাতে পানির  বাটি ধরে  খাওয়া যাবে না। বলবেন, ‘বাম হাতে বাটি ধর। ডাইন হাত বাটির (পেতলের বাটি, আধা লিটারের মতো ধরতো) তলায় রাখ। একহাতে পানি খায় না। এক হাতে পানি খাইলে শয়তানে পানিতে মুতে দেয়।’

আমিও দে ছুট। রুদ্ধশ্বাসে। লক্ষ্যহীন। পেছন পেছন মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে ছুটছেন ছোট খালাও।  

কিন্তু আজ নানার মন কেন জানি প্রসন্ন। হয়তো বাড়িতে জামাই এসেছে, তাই। হয়তো অনেক দিন পর বাড়িতে ভালোমন্দ খাওয়া হচ্ছে, তাই। মিনু এসে একবার নানার পায়ের সঙ্গে গা ঘষছে, আরেকবার ছোট খালার পায়ে। অন্যদিন ছোট খালা নিজের বাসন থেকে খাওয়ার তুলে মাটিতে মিনি সামনে রাখতেন। মিনিও চেটেপুটে খেতো। কিন্তু আজ ছোট খালার সেদিকে খেয়াল নেই। আমরা সবাই কই মাছ, সেদ্ধ ডিম, কাতলা মাছ, মোরগের গোস্ত দিয়ে খাওয়া শুরু করেছি। মিনিকে আজ নানা খাবার দিচ্ছেন। কিন্তু ছোট খালার কী হলো?

আমাদের সবাইকে দুই টুকরো করে মোরগ, এক টকুরো কাতলা মাছ, একটি ডিম, একটি কই মাছ দিলেন নানি। ছোট খালাকেও তাই দিলেন। কিন্তু ছোট খালা ভাত নাড়েন-ছাড়েন। কিন্তু মুখে তোলেন না। নানি বলেন, ‘কিরে রোকেয়া? কী অইছে? খাছ না ক্যা?’ এবার খালার আব্দার, ‘আঁরে আরও এক টুকরো মোগের গোস্ত দেন।’ নানি বলেন, ‘কিল্লাই?  ব্যাকেরে দিলাম দুই টুকরো করি, তোরে তিন টুকরা দিমু কিল্লাই?’ খালা বলেন, ‘দেননা। কী অইছে দিলে? আঁই খামু।’  নানি বলেন, ‘আগের দুইটা আগে খা।  খাইতি হাইরলে আরও দিমু।’

নানির জবাবে খালাকে বেশ বিমর্ষ দেখায়। চোখ দুটি থেকে যেন জল টপ টপ করে ঝরে পড়বে। ভাতের বাসন হাতে তুলে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন খালা। গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো মিনিকে পা দিয়ে মৃদ্যু ধাক্কায় সরিয়ে দিলেন। দুপ-দাপ পা পেলে ভাতের বাসন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উঠোনো। দেখে নানি খেঁকিয়ে উঠলেন। নানার উদ্দেশে বললেন, ‘দেখেন, দেখেন, আন্নের মাইয়ার জিদ। এইডা কিন্তুক ভালা অইলো না।’

ততক্ষণে খালা চলে গেলেন সেখানে, যেখানে বাঘা বসে ছিল—আমাদের উচ্ছ্বিষ্ট আর অ্যাঁটো ভাতের আশায়। আমরাও খাবারের বাসন ঢেকে রেখে তার পেছন পেছন ছুটে এলাম। দেখি যেই ছোট খালা বাঘাকে সহ্যই করতে পারতেন না, সেই তিনিই নিজের পুরো খাবার ঢেলে দিলেন কুকুরটির সামনে। নানি দেখে ক্ষেপে গেলেন—‘কী কইরলি তুই? জিদ করি নিজের ভাত-গোস্ত সব কুত্তারে দিলি? হারামজাদি!’ খালা আর সহ্য করতে পারলেন না। ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলেন। বললেন, ‘এই কুত্তারে এত ঘিন্না? এই কুত্তা না থাইকলে আইজ এই মোরগের গোস্ত আম্নেগো পেটে পড়তোনি?’ মুখে তর্ক করছেন, আর দুই হাতে বাঘার গলার নিচে আদর করছেন। বাঘাও আদুরে মানবসন্তানের খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট খালার কাণ্ড দেখে নানা-নানি আর মেজ খালা তো থ। কিন্তু বাঘা তো খাচ্ছে না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হয়তো মেজ খালা বললেন,  ‘নে বাঘা খা।’  বাঘাও খাওয়া শুরু করলো।

তাই দেখে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। অমনি ছোট খালা তেড়ে এলেন আমার দিকে। আমিও দে ছুট। রুদ্ধশ্বাসে। লক্ষ্যহীন। পেছন পেছন মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে ছুটছেন ছোট খালাও।

জীবনের যতিচিহ্নগুলো-১০

চলবে…

মন্তব্য